কোটা আন্দোলনে পুলিশ ও ছাত্রলীগের হামলার প্রতিবেদন।

0
22

সম্প্রতি বাংলাদেশে সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের দাবিতে শিক্ষার্থীদের শান্তিপূর্ণ আন্দোলন চলাকালীন পুলিশ ও ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের হামলার ঘটনা দেশব্যাপী তীব্র ক্ষোভ ও বেদনার জন্ম দিয়েছে। এই আন্দোলন, যা মূলত মেধাভিত্তিক নিয়োগের দাবি ও কোটা ব্যবস্থার বৈষম্য দূর করার লক্ষ্যে শুরু হয়েছিল, সহিংসতার মুখে পড়ে বহু শিক্ষার্থী ও সাধারণ মানুষের জীবনহানি ও আহতের ঘটনায় রূপ নিয়েছে। এই প্রতিবেদনে আমরা এই সহিংসতার চিত্র, নিহত ও আহতের পরিসংখ্যান এবং এর পেছনের কারণ ও প্রভাব নিয়ে আলোচনা করব।

আন্দোলনের প্রেক্ষাপট
কোটা সংস্কার আন্দোলন গত ২ জুলাই, ২০২৪ থেকে শুরু হয়, যখন শিক্ষার্থীরা সরকারি চাকরিতে কোটা ব্যবস্থার সংস্কারের দাবি তুলে রাজপথে নামে। ‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন’ নামে একটি প্ল্যাটফর্মের নেতৃত্বে এই আন্দোলন বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজ থেকে শুরু হয়ে রাজধানী ঢাকাসহ সারাদেশে ছড়িয়ে পড়ে। শিক্ষার্থীরা মুক্তিযোদ্ধা কোটা, ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী কোটা এবং অন্যান্য কোটার পরিমাণ কমিয়ে মেধাভিত্তিক নিয়োগের দাবি জানায়। তবে, আন্দোলন তীব্র হওয়ার সাথে সাথে পুলিশ ও ছাত্রলীগের হামলার ঘটনা ঘটতে থাকে, যা পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তোলে।

সহিংসতা ও হামলার চিত্র
১৫ জুলাই, ২০২৪ থেকে আন্দোলনের সহিংসতা বৃদ্ধি পায়, যখন ছাত্রলীগ ও যুবলীগের নেতাকর্মীরা শিক্ষার্থীদের শান্তিপূর্ণ মিছিলে হামলা চালায়। এরপর পুলিশ রাবার বুলেট, কাঁদানে গ্যাস, এবং কিছু ক্ষেত্রে সরাসরি গুলি ব্যবহার করে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করে। বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমের প্রতিবেদন অনুযায়ী, এই হামলার ফলে দেশের বিভিন্ন স্থানে নিম্নলিখিত ঘটনাগুলো ঘটেছে:

ঢাকা: ঢাকা কলেজ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনে ছাত্রলীগ ও পুলিশের সাথে সংঘর্ষে বহু শিক্ষার্থী আহত হয় এবং সেই ধারাবাহিকতায় মোঃ সোহান রানা নামে এক পুলিশ কনস্টেবল জড়িত আছে বলে ধারণা করা জায়।

১৬ জুলাই ঢাকা কলেজের সামনে একজন যুবক নিহত হন, যার মাথায় আঘাতের চিহ্ন পাওয়া যায়। সিটি কলেজের সামনে আরেকজনের রক্তাক্ত মরদেহ উদ্ধার হয়। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে চার শিক্ষার্থী গুলিবিদ্ধ হন, যাদের মধ্যে দুজনের অবস্থা গুরুতর ছিল।

চট্টগ্রাম: চট্টগ্রামের মুরাদপুর ও ষোলশহর এলাকায় ছাত্রলীগ ও যুবলীগের হামলায় তিনজন নিহত হন। নিহতদের মধ্যে ছিলেন চট্টগ্রাম কলেজের শিক্ষার্থী ওয়াসিম আকরাম (২২) এবং পথচারী ফারুক (৩২)। সংঘর্ষে ইটপাটকেল নিক্ষেপ ও ককটেল বিস্ফোরণের ঘটনাও ঘটে।

রংপুর: বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী আবু সাঈদ (২২) পুলিশের রাবার বুলেটে নিহত হন। তিনি আন্দোলনের সমন্বয়ক ছিলেন।

অন্যান্য স্থান: উত্তরা, রামপুরা, সাভার, নরসিংদী, এবং মাদারীপুরে সংঘর্ষে আরও বেশ কয়েকজন নিহত ও আহত হন। ১৮ জুলাই উত্তরায় চার শিক্ষার্থী নিহত হন, এবং মাদারীপুরে এক শিক্ষার্থীর মরদেহ শকুনি লেক থেকে উদ্ধার করা হয়।

নিহত ও আহতের পরিসংখ্যান
বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমের তথ্য অনুযায়ী, ১৬ জুলাই থেকে ২৩ জুলাই, ২০৪ পর্যন্ত কোটা আন্দোলনের সংঘর্ষে মোট ১৯৭ জন নিহত হয়েছেন, যাদের মধ্যে শিক্ষার্থী, পথচারী, সাংবাদিক, এবং পুলিশ সদস্য রয়েছেন। আহতের সংখ্যা দুই হাজারেরও বেশি। নিম্নে কিছু নির্দিষ্ট দিনের তথ্য দেওয়া হলো:

১৬ জুলাই: ৬ জন নিহত (ঢাকায় ২, চট্টগ্রামে ৩, রংপুরে ১)।

১৮ জুলাই: ১৩ জন নিহত, যার মধ্যে উত্তরায় ৪, ধানমণ্ডিতে ১, রামপুরায় ১, চট্টগ্রামে ২, মাদারীপুরে ১, এবং সাভারে ১।

১৯ জুলাই: ৪৪ জন নিহত, সারাদেশে মোট ৫৬ জন।

২০ জুলাই: ২৬ জন নিহত।
২১ জুলাই: ১৯ জন নিহত।
২২-২৩ জুলাই: আরও ১৩ জন নিহত, যার মধ্যে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ৫ জন এবং নারায়ণগঞ্জে ৩ জন।

আহতদের মধ্যে অনেকের শরীরে গুলির চিহ্ন পাওয়া গেছে। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ৫০ জনেরও বেশি শিক্ষার্থী ছররা গুলিতে আহত হন, এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ২৫০ জনেরও বেশি আহত হন।

প্রতিবাদ ও দাবি
এই সহিংসতার প্রতিবাদে ‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন’ ৯ দফা দাবি পেশ করে, যার মধ্যে রয়েছে:

স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও সড়ক পরিবহন মন্ত্রীর পদত্যাগ।
সংঘর্ষে জড়িত পুলিশ ও ছাত্রলীগ নেতাকর্মীদের গ্রেপ্তার ও বিচার।
নিহত ও আহতদের পরিবারের জন্য ক্ষতিপূরণ।
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ছাত্রলীগের রাজনীতি নিষিদ্ধকরণ।

প্রধানমন্ত্রীর কাছে প্রকাশ্যে ক্ষমা চাওয়ার দাবি।
শিক্ষার্থীরা অভিযোগ করেন যে, তাদের শান্তিপূর্ণ আন্দোলনকে সরকার ও ছাত্রলীগ সহিংসভাবে দমন করছে। তারা আরও দাবি করেন যে, পুলিশ ও ছাত্রলীগের হামলায় তিন শতাধিক শিক্ষার্থী ও নাগরিক নিহত হয়েছেন, যদিও সরকারি তথ্যে এই সংখ্যা নিশ্চিত করা হয়নি।

প্রভাব ও সমালোচনা
এই সহিংসতার ফলে দেশে ব্যাপক অস্থিরতা সৃষ্টি হয়েছে। ইন্টারনেট সংযোগ বন্ধ, কারফিউ জারি, এবং সেনাবাহিনী মোতায়েন করা হয়েছে। বিভিন্ন সরকারি প্রতিষ্ঠানে ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটেছে, যার মধ্যে বাংলাদেশ টেলিভিশন, মেট্রোরেল স্টেশন, এবং ডাটা সেন্টার উল্লেখযোগ্য।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় এই সহিংসতার নিন্দা জানিয়েছে, এবং শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভের অধিকারের প্রতি সমর্থন প্রকাশ করেছে। তবে, বাংলাদেশ সরকার মার্কিন বক্তব্যকে ‘ভিত্তিহীন’ বলে সমালোচনা করেছে।

উপসংহার
কোটা সংস্কার আন্দোলন শিক্ষার্থীদের ন্যায্য দাবির প্রতিফলন হলেও, পুলিশ ও ছাত্রলীগের হামলার ফলে এটি একটি রক্তক্ষয়ী ট্র্যাজেডিতে রূপ নিয়েছে। শত শত তরুণ-তরুণীর জীবনহানি ও আহতের ঘটনা জাতির জন্য একটি গভীর বেদনার কারণ। সরকারের উচিত এই সংকটের শান্তিপূর্ণ সমাধানের জন্য আলোচনায় বসা এবং দায়ীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করা। শিক্ষার্থীদের ন্যায্য দাবি মেনে নিয়ে এবং সহিংসতা বন্ধ করে দেশে শান্তি ও স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনা এখন সময়ের দাবি।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here