বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর একটি উচ্চপর্যায়ের প্রতিনিধি দল তুরস্কেরহ বিখ্যাত সামরিক সরঞ্জাম নির্মাতা প্রতিষ্ঠান Sarsılmaz-এর উৎপাদন সুবিধা পরিদর্শন করেছে। এই প্রতিনিধি দলে ছিলেন সেনাবাহিনীর লজিস্টিক্স বিভাগের কমান্ডার বাংলাদেশ সমরাস্ত্র কারখানার (BOF) ডেপুটি জেনারেল ম্যানেজার (ডিজিএম) এবং ডিরেক্টর অফ আর্মি কমান্ড। তারা Sarsılmaz-এর উৎপাদন কারখানা পরিদর্শন করেছেন এবং সেখানে নির্মিত বিভিন্ন ধরনের সমরাস্ত্রের পরীক্ষা নিরীক্ষাও চালিয়েছেন এই পরিদর্শনের সময় প্রতিনিধি দল SAR-15T এসল্ট রাইফেল ফায়ারিং পরীক্ষা করেছেন যা তুরস্কের নিজস্ব প্রযুক্তিতে নির্মিত একটি আধুনিক অস্ত্র।
Sarsılmaz এবং তাদের সমরাস্ত্র
Sarsılmaz তুরস্কের একটি শীর্ষস্থানীয় অস্ত্র নির্মাতা প্রতিষ্ঠান যা ১৮৮০ সাল থেকে অস্ত্রশিল্পে কাজ করছে এবং তুরস্কের প্রতিরক্ষা খাতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। তারা পিস্তল সাবমেশিন গান এসল্ট রাইফেল থেকে শুরু করে মেশিনগান পর্যন্ত বিস্তৃত অস্ত্র উৎপাদন করে এই প্রতিনিধি দলের পরিদর্শনের মূল উদ্দেশ্য ছিল Sarsılmaz-এর উৎপাদন ক্ষমতা এবং তাদের নির্মিত অস্ত্রের গুণগত মান পর্যবেক্ষণ করা বিশেষ করে SAR-308 এবং SAR-15T এসল্ট রাইফেল দুটি তাদের আধুনিক ডিজাইন ও উন্নত প্রযুক্তির জন্য উল্লেখযোগ্য।
SAR-308 এবং SAR-15T এসল্ট রাইফেল
SAR-308: এটি কিংবদন্তি AK-47 প্ল্যাটফর্মের একটি আধুনিক ও সম্পূর্ণ তুর্কি প্রযুক্তিতে নির্মিত সংস্করণ এই রাইফেলটি হালকা ওজনের উচ্চ-শক্তিসম্পন্ন পলিমার ম্যাগাজিন এবং স্টক দিয়ে সজ্জিত এর ক্যালিবার ৭.৬২×৩৯ মিমি যা ৬৫০ রাউন্ড প্রতি মিনিটে ফায়ার করতে পারে এবং এর মুখের বেগ ৭১৫ মি/সে এটি গ্যাস পিস্টন সিস্টেমে চলে এবং সব ধরনের জলবায়ুতে উৎকৃষ্ট পারফরম্যান্স প্রদান করে এতে একক ও সিরিয়াল শটের অপশন রয়েছে এবং এর কার্যকরী পাল্লা ৩৫০ মিটার।
SAR-15T: এটিও AK-47 প্ল্যাটফর্মের একটি আধুনিক সংস্করণ যা তুর্কি সশস্ত্র বাহিনী ব্যবহার করে এটি SAR-308-এর তুলনায় কিছুটা দীর্ঘ (৯৮০ মিমি) এবং ওজনে সামান্য ভারী (৩৮০০ গ্রাম) এটি একই ক্যালিবার (৭.৬২×৩৯ মিমি) ব্যবহার করে এবং গ্যাস পিস্টন সিস্টেমে চলে এর বিশেষ বৈশিষ্ট্য হলো ফোল্ডিং টেলিস্কোপিক স্টক যা বহন সুবিধাজনক করে এটি তুর্কি সেনাবাহিনীর জন্য বিশেষভাবে ডিজাইন করা হয়েছে এবং এর আধুনিক ডিজাইন এটিকে যুদ্ধক্ষেত্রে কার্যকর করে।
বাংলাদেশ সমরাস্ত্র কারখানা (BOF) এবং তুরস্কের সাথে সহযোগিতা:
বাংলাদেশ সমরাস্ত্র কারখানা (BOF) ১৯৭০ সালের ৬ এপ্রিল প্রতিষ্ঠিত হয় এবং গাজীপুরে ৩০৩ একর জমির উপর অবস্থিত এটি প্রাথমিকভাবে ৭.৬২ মিমি সেমি-অটোমেটিক রাইফেল টি-৫৬ উৎপাদনের জন্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। বর্তমানে BOF বিভিন্ন ধরনের ক্ষুদ্রাস্ত্র গোলাবারুদ গ্রেনেড মর্টার বোমা এবং ফিউজ উৎপাদন করে।
তুরস্কের সাথে প্রতিরক্ষা সহযোগিতার অংশ হিসেবে BOF-এ SAR-308 বা SAR-15T এসল্ট রাইফেল উৎপাদনের জন্য প্রযুক্তি হস্তান্তরের পরিকল্পনা রয়েছে এটি বাংলাদেশের প্রতিরক্ষা শিল্পকে আরও শক্তিশালী করবে এবং দেশীয়ভাবে আধুনিক অস্ত্র উৎপাদনের ক্ষমতা বাড়াবে। তুরস্কের প্রতিরক্ষা শিল্প সংস্থা REPKON ইতোমধ্যে চট্টগ্রামে একটি নতুন সমরাস্ত্র কারখানা স্থাপনে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সাথে কাজ করছে, যেখানে ১৫৫ মিমি কামানের গোলা উৎপাদনের জন্য উন্নত ফ্রি ফ্লোফার্মিং প্রযুক্তি এবং কম্পিউটারাইজড যন্ত্রপাতি ব্যবহৃত হবে।
CZ BREN-2 রাইফেল
চেক প্রজাতন্ত্রের নির্মিত CZ BREN-2 এসল্ট রাইফেল ইতোমধ্যে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর বহরে স্বল্প পরিসরে যুক্ত হয়েছে। এটি একটি অত্যাধুনিক মডুলার রাইফেল যা ৫.৫৬×৪৫ মিমি বা ৭.৬২×৩৯ মিমি ক্যালিবারে পাওয়া যায় এর হালকা ওজন উন্নত এরগনমিক্স এবং মডুলার ডিজাইন এটিকে আধুনিক যুদ্ধক্ষেত্রের জন্য উপযোগী করে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী এই রাইফেলটি বিশেষ বাহিনীর জন্য ব্যবহার করছে বলে ধারণা করা হয়।
বাংলাদেশ-তুরস্ক প্রতিরক্ষা সহযোগিতা:
গত কয়েক বছরে বাংলাদেশ এবং তুরস্কের মধ্যে প্রতিরক্ষা সহযোগিতা উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে বাংলাদেশ তুরস্ক থেকে বাইরাকটার টিবি২ ড্রোন কোবরা আর্মার্ড পার্সোনেল ক্যারিয়ার শর্ট-রেঞ্জ মিসাইল মাইন প্রটেক্টেড ভেহিকল এবং মাল্টি-ডাইমেনশনাল রকেট প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা সহ বিভিন্ন আধুনিক সমরাস্ত্র কিনেছে এছাড়া তুরস্ক বাংলাদেশ মেশিন টুলস ফ্যাক্টরিকে (BMTF) শেল উৎপাদনের প্রযুক্তি সরবরাহ করেছে এবং নৌবাহিনী ও কোস্ট গার্ডের জন্য প্যাট্রোল বোট উৎপাদনে প্রযুক্তি হস্তান্তরের প্রস্তাব দিয়েছে।
২০২৩ সালের ডিসেম্বরে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে বাংলাদেশ এবং তুরস্ক একটি প্রতিরক্ষা সহযোগিতা কাঠামো চুক্তির দিকে এগোচ্ছে যা দুই দেশের মধ্যে কৌশলগত অংশীদারিত্বকে আরও দৃঢ় করবে। তুরস্কের অস্ত্রের গুণগত মান সাশ্রয়ী মূল্য, এবং প্রযুক্তি হস্তান্তরের সুযোগ বাংলাদেশের জন্য এই সহযোগিতাকে আকর্ষণীয় করেছে।
সাম্প্রতিক উন্নয়ন:
চট্টগ্রামে নতুন কারখানা তুরস্কের REPKON-এর সহযোগিতায় চট্টগ্রামে একটি নতুন সমরাস্ত্র কারখানা স্থাপনের পরিকল্পনা চলছে যেখানে ৫৪.৯৯ একর জমিতে ১৫৫ মিমি কামানের গোলা উৎপাদন করা হবে এটি বাংলাদেশের প্রতিরক্ষা চাহিদা মেটাতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।
প্রশিক্ষণ:
তুরস্কে প্রায় ৩,০০০ বাংলাদেশী প্রতিরক্ষা কর্মকর্তা বিশেষ প্রশিক্ষণ নিয়েছেন যা দুই দেশের সামরিক সহযোগিতাকে আরও জোরদার করেছে।
নতুন অস্ত্র সংগ্রহ: বাংলাদেশ সেনাবাহিনী তুরস্ক থেকে TRG-230 MLRS, বাইরাকটার টিবি২ ড্রোন এবং অন্যান্য আধুনিক অস্ত্র সংগ্রহ করেছে, যা ফোর্সেস গোল ২০৩০-এর অংশ হিসেবে সশস্ত্র বাহিনীর আধুনিকীকরণে সহায়তা করছে।
উপসংহার
বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর তুরস্কের Sarsılmaz পরিদর্শন এবং SAR-308 বা SAR-15T এসল্ট রাইফেল উৎপাদনের জন্য প্রযুক্তি হস্তান্তরের সম্ভাবনা বাংলাদেশের প্রতিরক্ষা শিল্পের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ এছাড়া CZ BREN-2 রাইফেলের সংযোজন এবং তুরস্কের সাথে ক্রমবর্ধমান প্রতিরক্ষা সহযোগিতা বাংলাদেশের সশস্ত্র বাহিনীকে আরও শক্তিশালী ও আধুনিক করছে তুরস্কের সাশ্রয়ী মূল্যে উন্নত প্রযুক্।